Preaload Image
Back

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে গৃহীত শিক্ষানীতি অনুসারে। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়, ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত পূর্বতন বিদেশি ভাষা বিভাগের ভিত্তির উপর। অর্থ্যাৎ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিলো— বিদেশি ভাষা বিভাগ, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাথে একান্নবর্তী বিভাগ হিসাবে সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের অঙ্গীভূত ছিলো। বর্তমান স্থানে নতুন শিক্ষাভবন স্থাপন করা হলে, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে এই বিদেশি ভাষা বিভাগকে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট নামে এই শিক্ষাভবনে স্থানান্তর করা হয়।

এই আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠায় একটি পিছনের গল্প রয়েছে। এই গল্পটি হলো এই যে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিজেই এটি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি এটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন। বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-খুদা-এর পরামর্শে তিনি জাতীয় শিক্ষানীতিতে বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শিক্ষাকে অন্তুর্ভুক্তকরণের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই শিক্ষানীতি অনুযায়ী তিনি শিক্ষাব্যবস্থার ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে বিভিন্ন বিদেশি ভাষার পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা রেখেছিলেনে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে বিদেশি ভাষা (ইংরেজিসহ) পঠন-পাঠনের সুযোগ ছিলো। অর্থ্যাৎ ঐ শিক্ষানীতি অনুসারে একমাত্র ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সুযোগ ছিলো না। তিনি বিদেশি ভাষা সম্পর্কে এই চিন্তা-ধারাকে সম্বল করে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিদেশি ভাষায় শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত প্রথম শিক্ষানীতির ১.২ ও ৩. নং অনুচ্ছেদে বিবৃত রয়েছে যে, জাতীয় ভাষা বাংলা ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে এবং বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ রেখে এই শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। অধিকন্তু শিক্ষানীতির ৪.১১. নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের একটি আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপনের কথা বলা রয়েছে।

দেশে যখন বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা চলছিলো, তখন সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির আওতায় জাপান সরকার কর্তৃক নিয়োজিত জাপানি ভাষা শিক্ষক হিসাবে পূর্বতন বিদেশি ভাষা বিভাগে কর্মরত ছিলেন ডক্টর ৎসুয়োশি নারা। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাচীন বাংলা ভাষা (অবহটঠ বুলি) বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পরামর্শ করতে ঢেকে নিয়েছিলেন এই ৎসুয়োশি নারাকে। ৎসুয়োশি নারা আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা থেকে প্রণয়ন থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালু হয়। এই লেখক ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এই বিভাগে অতিথি শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। অধ্যাপক ৎসুয়োশি নারা সে বৎসরই ইহলোক ত্যাগ করেন। তিনি গত হয়েছেন সাত বছর আগে। কিন্তু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্মৃতি চিহ্ন রেখে গেছেন, তা পল্লবিত হয়ে জ্ঞানের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাচ্ছে। কিন্তু এর আগেই ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে গত হয়েছেন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মূল কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশের সবকিছু উলটপালট হয়ে যায়। সাথে সাথে মাটি চাপা পড়ে যায় বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনা। দেশজুড়ে শুরু হয় ইংরেজি নামক একক বিদেশি ভাষার শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি। আর ধাপাচাপা পড়ে যায় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের উন্নয়ন ও বিকাশের পথ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভুলে যায় আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের মূল পরিকল্পনার কথা। ধামাচাপা পড়ে যায় বিদেশি ভাষা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা। যে কারণে আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট তার মূল পরিকল্পনা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। তাই এখন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বিদেশি ভাষা সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম তেমন একটা পরিচালিত হয় না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর নিজ উদ্যোগে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে গৃহীত শিক্ষানীতি অনুসারে গঠিত আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে যে সব বিদেশি ভাষা বিভাগ খোলার প্রতিশ্রুতি ছিলো, সেগুলোর অর্ধেক ভাষায়ও পঠন-পাঠন এখনও শুরুই হয়নি। কাজেই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর তিরোধানে বিদেশি ভাষানীতি ভেস্তে গেছে, আর আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট প্রবেশ করেছে এক অন্ধকার যুগে।